জীবননগর অফিস:-
পাখিকে ভালবাসে না এমন মানুষ হয়তো খুজে পাওয়া যাবে না | তবে এক একজনের
ভালবাসার প্রকৃতি এক এক রকমের। কেউ পাখিকে খাদ্য খাওয়াতে,কেউ পাখি শিকার
করে আবার তা মুক্ত আকাশে ছেড়ে দিতে, কেউ পাখির জন্য
আবাসের ব্যবস্তা করতে আবার কেউ পাখি পালন করে নিজের ভাগ্য গড়তে পাখিকে
ভালবাসা দিয়ে থাকেন। তবে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলা শহরের রানার পাখির
প্রতি ভালবাসার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।তিনি পাখি বোবা সন্তান মনে করেন। হাসপাতালের
সামনে রানা এক্য্র-রে(x-ray) মানিউর রহমান রানার নিকট প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে শত
শত শালিক পাখি খাদ্যের জন্য ছুটে আসে। আর তখনই রানা তাহার হৃদয়ের সবটুকু
ভালবাসা উজাড় করে বন-জঙ্গল থেকে উড়ে আসা ক্ষুধার্ত শালিক পাখিগুলোর জন্য
খাবার তুলে দেন।পাখিগুলো এ সময় কিচিরমিচির শব্দ করে আর খাবার খেতে
প্রতিযোগীতায় নেমে পড়ে। রানা যতই খাবার ছড়িয়ে দেন ততই পাখিদের সংখ্যা
বাড়তে থাকে।এ যেন পাখি আর মানুষের মধ্যে এক অকৃত্রিম প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
রানার বাড়ী চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শহরের দোলতদিয়াড়। তার বাবার নাম ইউসুফ আলী| দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে জীবননগর হাসপাতালের সামনে রানা এক্য্র্র- রে নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে অত্যন্ত সুনামের সাথে ব্যবসার পাশাপাশি সমাজের অসহায়, হতদরিদ্র মানুষের জন্য মানবিক সাহায্য দিয়ে আসছেন। পাখি প্রেমিক মানিউর রহমান রানা জীবননগরে রানা এক্য্র রে নামে ব্যাপক পরিচিত|রানা এক যুগেরও বেশী সময় ধরে পাখিদের খাদ্য সরবরাহ করে আসছেন।
রানা আসলে একজন নানা গুনে গুণান্বিত মানুষ। তিনি একাধারে কবি সাহিত্যিক ও একজন চিত্র শিল্পী কার্টুনিস্ট। তার যেমন আছে হাত যশ,তেমন রয়েছে দক্ষতা। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে তার একাডেমিক্যাল কোন সনদ না থাকলেও তিনি উপজেলায় একজন দক্ষ,অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান হিসাবে পরিচিত|
প্রকৃতি প্রেমি রানা পাখি প্রেমী হওয়ার গল্পটা একটু ভিন্ন। করোনা কালীন সময়ে মানুষ যখন বিধি নিষেধের ঘরের বাইরে বের হতে পারছিলেন না। সে সময় প্রাণীকূল খাদ্য সঙ্কটে পড়ে। পাখির খাদ্য সঙ্কটে ব্যাপারটি সবাই অনুধাবন করতে না পারলেও প্রকৃতি প্রেমিক রানা ঠিকই বুঝতে পারেন পশু-পাখিরা খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে। সেই অনুধাবন থেকে পাখির প্রতি তার দরদও সৃষ্টি হয়।তিনি দেখতে পান,তার প্রতিষ্ঠানে সামনে গাছপালার ডালে ও বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের ছাঁদে এবং তার প্রতিষ্ঠানের সামনে চরে বেড়ানো কিংবা উড়ে আসা পাখিদের কিচির মিচির শব্দে তিনি বুঝতে পারেন পাখিরা ক্ষুধার্ত। তাই তো তিনি কিছু সংখ্যক পাখির জন্য কিছু কিছু খাদ্য দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি নিয়ম করে প্রতিদিন পাখির জন্য তার প্রতিষ্ঠানের সামনে দিতে থাকেন। প্রথম দিকে অল্প সংখ্যক পাখি খাদ্য খেতে আসলেও এখন প্রতিদিন আশেপাশের এলাকা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক পাখি আসে রানার দেয়া খাদ্য খেতে|
রানা তার উপার্জিত অর্থ থেকে একটি অংশ প্রতিদিন পাখিদের জন্য ব্যয় করেন। তিনি প্রতিদিন দু,’দফায় শালিক পাখিসহ শত শত অন্যান্য পাখির জন্য খাবার দিয়ে থাকেন। প্রতিদিনই তার খাদ্য খেতে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। শত শত পাখির খাদ্যের ব্যবস্থা করার পাখির প্রতি তার ভালবাসাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাখির ভালবাসাময় প্রশংসার ভাসছেন রানা। প্রথমদিকে শালিক পাখিরা খাদ্য খাওয়ার সময় ভয় পেলেও এখন শালিক আর রানা একাকার। ভয় তো দুরের কথা রানা খাদ্যের পাত্র বের করার সাথে সাথে খাদ্য ছিনিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নামে|
রানা আর শালিক পাখিদের এমন ভালবাসা দেখলে মনে হবে রানা পাখিগুলো দীর্ঘদিন ধরে পালন করেছেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। খাবার দিলেই ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে শত শত শালিক পাখি। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে মুড়ি,চানাচুর,কেক,বিস্কুট ইত্যাদি এক সাথে গুড়ো কিংবা টুকরো করে ছিঁটালেই আশেপাশে থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক পাখি উড়ে এসে খাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করে দেয়। পাখি আর এখনকে ভয়ও পায় না। রানার ভালবাসার পরশে পাখিগুলো নির্ভয়ে মনের আনন্দে খেয়ে চলে যায় তাদের ঠিকানায়। পরের দিন আবারও যথাসময়ে আশেপাশে এসে কিচিরমিচির শব্দ করলেই রানা তাদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। এদৃশ্য দেখে অনেকে কৌতুহল হন। রানা যেন শালিক পাখিদের অতি পরিচিত ও আপনজন|
রানা বলেন, করোনার প্রথমদিকে ৩০-৪০ টি পারি খাবার খাওয়ার জন্য আসতো। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন ২০০-৩০০ টি পাখির নিয়মিত খাবার দিয়ে থাকি। তবে প্রতিদিন পাখিদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পেরে আমার ভাল লাগে। পাখিরা আমার বোবা সন্তান সমতুল্য। তারা কথা বলতে না পারলেও তাদের আচরন দেখে বুঝতে পারি তারা আমার নিকট খাবার দাবী করছে। আমি যদি পারব,ততদিন ওদের খাবার দিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখব ইনশাআল্লাহ। শালিকদের সাথে অনেক সময় কাঠ বিড়াল,ফিঙে রাজা,মাছ রাঙা ও চড়ুই পাখিদেরও ছুটে আসতে দেখা যায়।
হাসপাতালের সামনে ফাইভ স্টার ফার্মেসি মালিক মাসুদ হোসেন বলেন,রানা ভাই বনের পাখির জন্য দীর্ঘদিন ধরে যা করছেন তা প্রশংসার দাবিদার। তিনি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আসা মাত্রই পাখিদের আনাগোনা বেড়ে যায় এবং কিচির মিচির শব্দ করতে থাকে রানা ভাই খাবার দেয়ার সাথে সাথে ঝাঁকে পাখি আসতে থাকে। রানা ভাই খাবার দেয়ার সাথে সাথে পাখিকেরা খেয়ে বাসায় ফিরে যায়। রানা ভাই আগে এক্য্র রে রানা নামে উপজেলা ব্যাপী পরিচিত হলেও এখন পাখি প্রেমিক রানা ভাই নামে পরিচিত।
জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ডা.জাহাঙ্গীর আলম বলেন,রানা সত্যিকারের একজন মানবিক মানুষ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব অর্থায়নে ৩০০-৪০০ পাখির খাবারের ব্যবস্থা করে আসছেন। পাখির জন্য কোন ব্যক্তি খাদ্য দিতে পারেন। তাতে কোন আপত্তি তোলে না রানা। রানাকে এই কাজটি আমি দশ বছর ধরে করে আসতে দেখছি। তবে তাকে সহযোগিতা করা হলে তার জন্য কাজটি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে|সকলে এগিয়ে আসলে জীবননগরে পাখির জন্য অভয়ারান্য গড়ে তোলা সম্ভব।
জীবননগর পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম বলেন,রানার মত সকলেই পাখিদের প্রতি আন্তরিক হওয়া দরকার। দিনে দিনে পাখির আবাস হারিয়ে যাচ্ছে। বনজঙ্গলের অভাবে দেশীয় অনেক জাতের পাখি বিলুপ্তির পথে। পাখিদের অবাধ বিচরন নিশ্চিত করতে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।