বিশেষ প্রতিনিধি:-
এ বছর অস্থির মূল্যের তালিকায় এসেছে সচরাচর স্থিতিশীল থাকা সবজি আলু। এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে সবজিটি। গত দুদিনে বাজারে আলুর দাম আরো বেড়ে এখন প্রতি কেজি হয়েছে ৪০ টাকা, যা আগে ছিল প্রতি কেজি ৩৫ টাকা। আলুর এ মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়েছে ঈদের পর থেকে। ঈদের পরপর প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ২৫ টাকা। অর্থাৎ এক মাসেরও কম সময়ে কেজিতে দাম বেড়েছে ১৫ টাকা।
আলুর এ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যেও। সংস্থাটি বলছে, বাজারে গত এক মাসের ব্যবধানে আলুর দাম ২৯ শতাংশ, আর বছর ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। গত বছরের এই সময় প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ১৮ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে, যা এখন ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে আলুর মূল্যবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর (২০২২-২৩) দেশে ১ কোটি ১১ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে বেশি। ওই বছর দেশে আলু উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এ উৎপাদন দেশে আলুর চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। দেশে বার্ষিক আলুর চাহিদা ৮৫ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ লাখ টন।
অন্য বছর চাহিদার চেয়ে আলুর উৎপাদন বেশি হওয়ায় সচরাচর বাজারে দাম স্থিতিশীল থাকত। মৌসুমের শেষে হিমাগারগুলোতে আলু অবিক্রীত থেকে যেত। বছর শেষে লোকসানের কথা বলতেন ব্যবসায়ীরা। এ বছর হিমাগারে পর্যাপ্ত আলু থাকার পরও দাম বাড়ছে। কারণ হিসেবে কেউ বলছেন বাড়তি চাহিদার কথা কেউ বলছেন অন্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব। তবে সিন্ডিকেটের আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
ঊর্ধ্বমুখী এ বাজারে আলুর বাড়তি দাম নিম্নআয়ের পরিবারগুলোতে বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় এ সবজির চড়া দাম প্রভাব ফেলেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতাদের দৈনন্দিন খরচেও। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচা বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে কথা হয় দিনমজুর রফিক মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, ‘ঈদের পরপরই বেড়েছে মসলা, ডিম, ভোজ্যতেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম। প্রতি সপ্তাহেই কাঁচাবাজারে কোনো না কোনো নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এবার নতুন করে সেই তালিকায় যুক্ত হলো আলু। এখন কোনো কিছুতে স্বস্তি নেই।’
তিনি বলেন, ‘অন্য সবজি না কিনতে পারলেও আগে আলু খাওয়া যেত। এখন সেই পরিস্থিতিও নেই। গরিব মানুষ কী খেয়ে বাঁচবে সেটা কেউ ভাবে না।’ সেগুনবাগিচাসহ রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শান্তিনগর ও হাতিরপুল বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাদা ও লাল আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি, যা দুদিন আগে ছিল ৩৫ টাকা। তবে কারওয়ান বাজারে কয়েকটি দোকানে প্রতি কেজি আলুর দাম এখনো ৩৫ টাকা রাখা হচ্ছে। যদিও অন্য বাজারে এ দামে বিক্রি করা দোকানের সংখ্যা কম।
জানা গেছে, এখন যারা আগের দামে আলু বিক্রি করছেন, তারা আগেই কিনে রেখেছেন। কারওয়ান বাজারের আলু ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন, ‘পাইকারি বাজারেই আলুর দাম কেজিতে ৫ টাকা বেশি। আমরাও সে হিসাবে দাম সমন্বয় করে মানভেদে কেজিপ্রতি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা নিচ্ছি। তবে আগে কেনা থাকলে কিছুটা কম নেয়া যাচ্ছে।’
এ বাজারের পাইকারি আলু ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘দুদিন হলো পাইকারিতে আলুর দাম বেড়েছে। আগে প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) আলু বিক্রি করেছি ১৫০ টাকায়। এখন বিক্রি করছি মানভেদে ১৫৬ টাকায়। অর্থাৎ পাইকারিতে দু’দিনের ব্যবধানে কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে।’
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের যেসব অঞ্চলে আলু উৎপাদন হয়, সেসব এলাকায়ও সব ধরনের আলুর দাম বেড়েছে। বগুড়া অঞ্চলেই গত তিন সপ্তাহের ব্যবধানে হিমাগার পর্যায়ে পাইকারিতে সব ধরনের আলুর দাম বেড়েছে।
বগুড়া শেরপুরের আলু ব্যবসায়ী ইয়াকুব আলী জানান, ‘ঈদের পর থেকে হিমাগারে প্রতি কেজি সাদা (গ্র্যানুলা) আলু ও লাল (কার্ডিনাল) আলু কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। পাশাপাশি বগুড়ার বিখ্যাত দেশি ছোট বা পাকড়ি জাতের আলু প্রতি কেজি ১২-১৫ টাকা বেড়েছে। তিন সপ্তাহবাদে এখন হিমাগারে প্রতি কেজি সাদা ও লাল আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৪ টাকায়। আর দেশি পাকড়ি আলুর কেজিপ্রতি দাম উঠেছে ৩৮ টাকা।
ওই এলাকার এসএস কোল্ড স্টোরের কর্ণধার সুমন পাটোয়ারী বলেন, ‘দাম বাড়ার কারণে এবার হিমাগারে সংরক্ষিত আলু তোলার (ছাড় করার) হিড়িক পড়েছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন জাতভেদে প্রতি বস্তা আলুতে (৬০ কেজি) ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মুনাফা হচ্ছে। এ কারণে সংরক্ষণ মৌসুম শুরু হতে না হতেই হিমাগার থেকে আলু বিক্রির হিড়িক পড়েছে।’
এদিকে দেশে আলু সরবরাহে কোনো সঙ্কট থাকার কথা নয় বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর উদ্বৃত্ত আলুতে আমাদের সমস্যা হয়। অবিক্রীত থেকে যায়। চাষিদের লোকসান হয়।’
এ বছরও আলুর ব্যাপক ফলন হয়েছে। চাষের জমির পরিমাণ কিছুটা কমলেও ফলন ভালো হওয়ায় উৎপাদন গত বছরের থেকেও বেড়েছে। তারপরও আলুর দাম কেন বাড়ল সেটা বুঝতে পারছি না।’ মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘হিমাগার মালিকরা এ বছর আলু ধরে রেখেছেন। তারা ৪০ হাজার টন আলু এখনো বীজের জন্য রেখেছেন। এ পরিমাণ আলু প্রয়োজন নেই। বাজারে দাম বাড়ানোর জন্য তারা কিছুটা সমস্যা করছেন।