গৌরীপুরে ডাকঘরে সেবা নেই জড়াজীর্ণ ভবনে চলছে কার্যক্রম প্রিয়জনদের চিঠি আসে না একটিও মাসে তালাকের চিঠি আসে

সাজ্জাতুল ইসলাম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) :
’করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি দিও খামে’– কবি মহাদেব সাহার ‘চিঠি দিও’ কবিতার এই লাইনগুলোই বলে দেয় প্রিয়জনের একটি চিঠির জন্য কতটা ব্যাকুল থাকত মানুষ।

প্রিয়জনকে চিঠি পাঠিয়ে মানুষ উত্তরের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করত, কখন আসবে ডাক পিয়ন। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে চিঠি ও ডাকঘর সেই আবেদন হারিয়েছে।

গুরুত্ব কমে গেলেও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের চিঠি আদান-প্রদান, চাকরির আবেদন, সঞ্চয়পত্র লেনদেনসহ বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ কাজের জন্য এখনও ডাকঘরে যেতে হয়। তবে কর্তাব্যক্তিদের উদাসীনতার কারণে ডাক বিভাগের সেবাবঞ্চিত হচ্ছে মানুষ।

এদিকে গীতিকার মনিরুজ্জামান মনিরের কথায় আলম খানের সুরে শিল্পী রুনা লায়লার কণ্ঠে এক সময়ের তরুণ-তরুণীদের কণ্ঠেও জনপ্রিয় ছিল-‘চিঠি কেন আসে না, আর দেরি সহে না, ভুলেছ কি তুমি আমাকে-ভুলেছ কি নাম ঠিকানা? হ্যাঁ; তরুণ-তরুণীরা শুধু গান নয়, চিঠির বক্সের কথাও ভুলে গেছেন।

একসময় বন্ধু, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বজন কিংবা পরিবারের সদস্যদের চিঠির অপেক্ষায় থাকতেন অনেকেই। এখন আধুনিক প্রযুক্তির ফলে যোগাযোগ সহজ হয়েছে। প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে চিঠির ব্যবহার। দাপ্তরিক কাজ ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিঠির ব্যবহার আর হয় না বললেই চলে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই আর কদর নেই ডাকবাক্সের। দেশের অন্যান্য জায়গার মতো ময়মনসিংহের অবস্থাও এমন। চিঠি লেখার অভ্যাস কমতে যাওয়ায় কাজে আসছে না রাস্তার ধারের ডাকবাক্সগুলোর। আগে দিনে দু-তিন বার ডাক বিভাগের কর্মীরা রাস্তার ধারের বাক্স থেকে চিঠি নিতে আসতেন। এখন সেই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে একবারে শূন্যের কোঠায়। খামে ভরা প্রাতিষ্ঠানিক চিঠিগুলো এখন শুধু ডাকঘরের বাক্সে পাওয়া যায়।
জানা গেছে, গৌরীপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ১৪টি পোস্ট অফিসের অধিকাংশগুলোই নান সমস্যায় জর্জরিত। এখন অধিকাংশ কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এদিকে উপজেলা সদরের পোস্ট অফিসের সামনে রক্ষিত ডাকবক্সে এক বছরেও কেউ চিঠি রাখেনি।

এ বছরে কোন স্বজন ও প্রেমিক-প্রেমিকাদের একটি চিঠিও আসেনি এ ডাকঘরে! তবে প্রতি মাসেই মিলছে তালাক ও আদালতের সমনজারির চিঠি! এই পোস্ট অফিসগুলোতে আধুনিক গ্রাহকসেবা দেওয়ার নামে ‘ডিজিটাল পোস্ট অফিস’ কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে।

প্রত্যেকটি ডাকঘরে তিনটি ল্যাপটপ, স্ক্যানার মেশিন, প্রিন্টার্স, ২৪ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধার জন্য আইপিএস, আধুনিক সরঞ্জামসহ প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয় করা হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ ভবনে চলছে উপজেলার প্রধান ডাকঘরের কার্যক্রম। ছাদ চুয়ে পানি পড়ে। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে, দরজা-জানালাও ভাঙা। জনবল সংকটের কারণে সেবা কার্যক্রমের গ্রাহকদের ভোগান্তি বাড়ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থিত সিংহভাগ ডাকঘরগুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে নির্ধারিত সময়ে ডাক কার্যক্রম না করার নানান অভিযোগ। সেবাগ্রহীতা ডৌহাখলা এলাকার মাসুদ পারভেজ জানান, এখন ডাকঘরে গেলে কোন সেবা পাওয়া যায় না। তাদের কাছে কোন ডাক টিকিটও থাকে না।

সেবা নিতে গেলে উল্টো খারাপ আচরণ করে। অপর দিকে মাওহা ইউনিয়নের ভুটিয়ারকোণা বাজারে সেবা গ্রহীতা জাহাঙ্গীর আলম জানান, ডাকঘর কি এমনই থাকবে ? সেবা দিতে না পারলে ডাকঘর বন্ধ করে দেয়া হোক। আর তা না হলে সেবা যাতে পাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করা হোক।

শ্যামগঞ্জ এলাকার রতন সাহা বলেন, এ আধুনিক সমাজে মানুষ এখন প্রবাসী স্বজনদের সঙ্গে কিংবা প্রিয়জনের যোগাযোগের সুযোগটা যখন ইচ্ছে তখনই অনলাইনে উপভোগ করছেন। এখন তো ডাকঘর কিংবা ডাক বাক্সের এমন নাজুক অবস্থা হবেই। শেফালী বেগম নামের অপর এক গৃহবধু বলেন, ‘আমার স্বামী ১৬ বছর যাবৎ প্রবাসে চাকরি করেন।

প্রতি বছর একবার ছুটিতে আসেন। আগে একটি চিঠির জন্য অপেক্ষা করতাম তার খোঁজখবর জানার জন্য। পিয়নকে দেখলেই জিজ্ঞাসা করতাম, আমাদের চিঠি আছে নাকি? এখন প্রতিদিনই মোবাইলে ভিডিও কল দিয়ে সরাসরি কথা বলি। চিঠির কথা প্রায় ভুলেই গেছি।’
বোকাইনগর ইউনিয়নের ভবানীপুর ডাকঘরের পোস্টমাস্টার (ইডিএ) মহসিন মাহমুদ শাহ জানান, এক বছরের মধ্যেই এসব যন্ত্রাংশ বিকল (নষ্ট) হয়ে গেছে। সরকারি বিভাগে চাকরি করি, আমাদের বলা হয় অবিভাগীয় কর্মচারী। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে যাতায়াত খরচও হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, এখন বছরে একটাও প্রেমিক-প্রেমিকার চিঠি আসে না, পোস্টম্যানদেরও সেই রকম কদর নেই। অথচ প্রতি মাসে প্রায় ২০টি করে তালাকনামা সহ আদালতের চিঠি আসে!
উপজেলা পোস্ট অফিসের উদ্যোক্তা মো. বাবুল মিয়া জানান, আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে চালু হতে যাচ্ছে ‘স্মার্ট সার্ভিস সেন্টার।’ এ সেন্টারের মাধ্যমে ভিসা, পাসপোর্ট, ওয়ারিশান সনদ, জমি সংক্রান্ত, শিক্ষার্থী ও হজযাত্রীদের পাক-নিবন্ধনসহ ৮৬টি বিষয়ে প্রাহকদের সেবা প্রদান করা হবে।
উপজেলা পোস্টমাস্টার বাবুল চন্দ্র দাস জানান, প্রধান ডাকঘরের ছাদের পলেস্তারা উঠে গেছে ও ছাদ চুয়ে ভিতরে পানি পড়ে মূল্যবান কাগজপত্র নষ্ট হচ্ছে। তিনি আরও জানান, এ পোস্ট অফিসে তিনজন রানারের মধ্যে একজনের পদ শূন্য, অপারেটর তিনজনের পদই শূন্য, একটি শাখা পোস্টমাস্টার, দুইজন বিলিংম্যান ও পোস্টম্যান একজনের পদ শূন্য রয়েছে। তিনি জানান, ডাক বিভাগকে ডিজিটাল পোস্ট অফিসে পরিণত করার জন্য প্রত্যেকটি পোস্ট অফিসে একজন করে উদ্যোক্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কাঙ্খিত আয় না হওয়ায় সব ডাকঘরের উদ্যোক্তারা চলে গেছেন। এ খাতে দেওয়া কম্পিউটার ও ডিজিটাল মেশিনের নানা যন্ত্রাংশ বর্তমানে বিকল অবস্থায় পড়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *