সাজ্জাতুল ইসলাম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ):-
আমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও সান্তনা যে দেশকে ‘স্বৈরাচার’ মুক্ত করেছি। জালিম ফ্যাসিস সরকারের বিদায় হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এবং বহু রক্তের বিনিময়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছি। যদি আমার আরেকটা চোখও নষ্ট হয়ে যেত তা হলেও আমার কোনো দুঃখ থাকত না। এখন আমার ওই এক চোখ দিয়েই নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি।’
কথাগুলো বলছিলেন (লেগুনা) গাড়ি চালক মো. আব্দুল্লাহ বাবু (২৪)। পুলিশের ছররা গুলিতে চোখের আলোর সাথে অনিশ্চয়তায় ভবিষ্যত জীবন তার। ঢাকার দক্ষিন কেরানীগঞ্জ থানার ইকুরিয়া এলাকায় গাড়ী চালাতো বাবু।
গাড়ির চাকা ঘুরলেই জীবনের চাকা ঘুরে এ পরিবারের। তবে ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে থমকে আছে পরিবারটির আয়-রোজগার। চোখের আলো হারানোর সঙ্গে চরম অনিশ্চয়তায় পড়ছে বাকি জীবন। অপরাধ একটাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে আওয়াজ তুলেছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত রাজপথ কাঁপানো শ্লোগান দিতো ময়মনসিংহের গৌরীপুরের মো. আব্দুল্লাহ বাবু। তিনি উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের কলতাপাড়া গ্রামের আব্দুল বারেকের ছেলে। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশে ছোড়া রাবার বুলেটে চোখ, মুখ-নাকে গুলিবিদ্ধ হন।
এতে তার বাম চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। ওই চোখে মোটেও দেখতে পাচ্ছেন না। অপর চোখেও এখন ঝাপসা দেখছেন। ফলে টাকার অভাবে এখন চিকিৎসা করতে পারছে না বাবুর পরিবার। তবে একটি চোখ হারালেও দেশের জন্য কিছু করতে পেরে গর্ববোধ করছেন তিনি।
জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ মো. আব্দুল্লাহ বাবুর পিতা আব্দুল বারেক ছিলেন জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদলের নেতা । বাবা’র সাথে সাথে ছেলে বাবু বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সাংগঠনিক কর্মসূচীতে সক্রিয় ছিলেন বাবু। সংসারের আর্থিক অনটনের জন্য ঢাকার দক্ষিন কেরানীগঞ্জ থানার ইকুরিয়া এলাকায় লেগুনা গাড়ি চালাতেন মো. আব্দুল্লাহ বাবু। তার আয়ে চলতো পরিবারের ৫ সদস্যর ভরন পোষন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে বাবু ছিলো মিছিলের অগ্রভাগে। পুলিশের গুলিতে ইতোমধ্যে বাবুর বাম চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। চিকিৎসক বলেছে এ চোখে আর দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। তার ডানচোখেও গুলির আঘাত লাগায় সেই চোখটি ক্রমান্বয়ে ঝাপসা হয়ে আসছে। সেই চোখ দিয়ে দুরের জিনিস দেখতে পায় না বাবু।
তাকে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ জামায়তে ইসলামীর পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা ও আরেকটি সংগঠন এক লাখ টাকার আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। তবে চোখের চিকিৎসা আরও চালিয়ে যেতে হবে। সন্তানের সুচিকিৎসা ও সংসারের ভরন পোষণের জন্য ৬৫ বছরের বৃদ্ধ বাবা আব্দুল বারেক পুনরায় গাড়ি চালাতে শুরু করেছেন। চার ছেলের মাঝে বাবু সবার ছোট।
বড় ছেলে মো. সুজন মিয়া ঢাকার সায়দাবাদে পুরাতন মবিলের দোকানে কাজ করেন। অপর ছেলে মো. রাজন মিয়াও গাড়ি চালান এবং ছোট ভাই মো. সজল মিয়া গার্মেন্টস কর্মী ছিলেন। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর কোম্পানী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেও এখন বেকার।
দেড় বছরের মো. আনার মিয়া নামে এক শিশু সন্তান নিয়ে বাবু’র সংসার। স্ত্রী নাসরিন প্রীতি পেশায় গৃহিনী। সংসার আর বাবু’র সুচিকিৎসার জন্য দিশাহীন হয়ে পড়েছেন বাবা আব্দুল বারেক। একদিকে বেড়েছে খরচ, অপরদিকে বন্ধ হয়ে গেছে সংসারের একমাত্র উপার্জক্ষম বাবু’র কাজকর্ম।
আব্দুল বারেক বলেন, আমার সন্তানের উপর এভাবে যারা গুলি ছোঁড়েছে, আমি তাদের বিচার চাই। তিনি আরও বলেন, আমার সন্তান তো আর কখনও গাড়ি চালাতে পারবে না। তার তো একটি কর্মসংস্থান প্রয়োজন।
তা না হলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কিভাবে বাঁচবে। পুলিশের ছররা গুলিতে বাম চোখ হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ডান চোখে পৃথিবীর আলো ফিরবে কিনা সে শঙ্কায় গুণছেন দিনক্ষণ সহধর্মিণী নাসরিন প্রীতি এখন কান্নার সহযাত্রী।
মো.আব্দুল্লাহ বাবু জানান, আমরা একটি স্বপ্ন নিয়ে শ্লোগান ধরেছিলাম। সেই স্বপ্ন পূরণে একটি-দুটি চোখ কেন, জীবন চলে গেলেও ফিরে আসতাম না। আমি ঝাপসা চোখেই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন দেখেছি!
এ আমার মহাবিজয় ও মহা আনন্দের। বাবু আরো বলেন, চোখ হারিয়ে ‘দেশের জন্য কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পেরেছি। এজন্য গর্ববোধ করছি।’