ঝিনাইদহের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠজুড়ে রয়েছে যেন হলুদের গালিচা

আবু সাইদ শওকত আলী , ঝিনাইদহ-

ঝিনাইদহ জেলার ছয়টি উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে চলতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ জমিতে উন্নত জাতের সরিষা চাষ হয়েছে।

বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠজুড়ে রয়েছে যেন হলুদের গালিচা।বেড়ে ওঠা গাছ আর ফুল দেখে অধিক ফলনের স্বপ্ন বুনছেন কৃষক- কৃষানি।

গত বছর স্থানীয় বাজারে উন্নত জাতের সরিষার চাহিদা ও দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকরা এবার সরিষা চাষে অধিক আগ্রহী হয়ে উঠেছে পাশাপাশি ব্যস্ততা বেড়েছে মৌ চাষিদের মধু সংগ্রহে।

আবহাওয়া  অনুকূলে  থাকলে গত  বছরের  তুলনায় চলতি মৌসুমে প্রত্যেক সরিষা চাষি অধিক লাভবান হবেন বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগ।

ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় চলতি মৌসুমে সরিষার লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৬০৬ হেক্টর জমিতে কিন্তু আবাদ হয়েছে ১২ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে।

ভবিষ্যতে  সরিষার আবাদ  আরও বৃদ্ধি পাবে এবং অচিরেই ভোজ্য তেল আমদানি করা বাদেই সরিষা থেকে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। এমনকি এ জেলার ভোজ্য তেলের চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলাতে রফতানি করা সম্ভব হবে।

উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সদর উপজেলায় ৩৫-৩৮ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৩৫৫ মেট্রিক টন।

সিংহভাগই কৃষকরা জমিতে উচ্চ ফলনশীল বারি সরিষা-১৪ ও টরি-৭ জাতের সরিষা চাষ করেছেন।

চলতি মৌসুমের শুরুতে উপজেলা কৃষি বিভাগ অধিক ফলনশীল বারি সরিষা-১৪ ও টরি-৭ জাতের সরিষা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে।

এ দুটি জাতের সরিষা মাত্র ৭০-৭৫ দিনে ঘরে তোলা যায়। প্রতি হেক্টরে বারি সরিষা-১৪ জাত ১.৪১৬ টন ও টরি-৭ জাতের ফলন হয় ০.৯৫১ টন। সরিষা কেটে ওই জমিতে আবার বোরো আবাদ করা যায়।
শৈলকুপা উপজেলার ধলহরাচন্দ্র গ্রামের চাষি রফিকুল ইসলাম  এর সাথে কথা বলে জানা যায়,সরিষা লাভজনক একটি ফসল।

সরিষা চাষে আর্থিক খরচ ও শ্রম দু’টিই কম লাগে। তাছাড়া গত বছর সরিষার নায্যমূল্য পাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা এবার ব্যাপকভাবে সরিষা চাষ করেছেন।

সরেজমিনে এলাকা পরিদর্শনে দেখা গেছে, সদর উপজেলার ভবানিপুর ফসলের মাঠগুলো সরিষা ফুলের হলুদ রঙে অপরুপ শোভা ধারণ করেছে।

এটা দেখে মনে হচ্ছে যেন হলুদের গালিচা বিছানো রয়েছে। ইতোমধ্যে কোন কোন জমিতে তাজা সরিষা ফুল, কোন জমিতে ফুল ঝরতে শুরু করেছে,

কোন জমির গাছগুলোতে আবার সরিষার দানা বাঁধতে শুরু করেছে। প্রতিটি জমিতেই তরতাজা সবুজ সরিষা গাছগুলোতে হলুদ ফুলে ফুলে ভরে ওঠায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটতে শুরু করেছে।

ভবানিপুরের চাষী আব্দুল বারি বলেন, এ বছর ৫ বিঘা জমিতে টরি-৭ জাতের সরিষার আবাদ করেছি।

বিঘা প্রতি ৩-৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি ফলন ভালো হবে। শুরু থেকেই কৃষি অফিস নানা উপকরণসহ পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছে।

একই এলাকার চাষী পারভেজ মোশারফ জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ৮ বিঘা জমিতে বারি সরিষা-১৪ জাতের উচ্চ ফলনশীল সরিষা চাষ করেছেন।

যা থেকে তিনি ৮০ মণ সরিষা পাবেন বলে আশা করছেন। বর্তমানে প্রতিমণ সরিষা ৩০০০-৩৫০০ টাকা দরে ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, গত বছর ৮ বিঘা জমিতে খরচ খরচা বাদে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিলো।

হরিণাকুন্ডু উপজেলার চারাতলা এলাকার চাষী মোশারফ হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ৪ বিঘা জমিতে বারি সরিষা-১৪ জাতের উচ্চ ফলনশীল সরিষা চাষ করেছেন।

এতে ফলন ভালো পাবো বলে আশা করছি। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে সরিষা চাষে অধিক লাভ হবে বলে মনে করছি।

কালীগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের চাষি বিপলুর রহমান এর সাথে কথা বলে জানা যায়, সরিষা লাভজনক ফসল। সরিষা চাষে আর্থিক খরচ ও শ্রম দু’টিই কম লাগে। তাছাড়া গত বছর সরিষার নায্যমূল্য পাওয়ায় এবারও সরিষা চাষ করেছি।

মহেশপুর উপজেলার নাটিমা গ্রামের রনিকুল ইসলাম জানান, সরিষা চাষে আর্থিক খরচ ও শ্রম দু’টিই কম লাগে তাই এবার সরিষা চাষ করেছি। আশা করি ফলন ভালো পাবো। তবে যদি নায্যমূল্য পায় তাহলে আমি লাভোবান হবো বলে আশা করি।

কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামের চাষি আবদুর রহমান জানান, আমি প্রতি বছর সরিষা চাষ করি কারণ সরিষা থেকে যে তৈল পায় তা নিজের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রী করে থাকি। আর সরিষা হলো লাভজনক ফসল। এতে আর্থিক খরচ ও শ্রম কম লাগে।

সদর উপজেলার বিষয়খালী গ্রামের কৃষক জিয়াউর রহমান বলেন, গত বছর বৃষ্টিপাতের কারণে সরিষার ফলন কম হয়েছিলো কিন্তু বাজারে দাম ভালো পাওয়ায় কৃষি অফিসের পরামর্শে এবার ৫ বিঘা জমিতে উন্নত জাতের সরিষা আবাদ করেছি।

প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সরিষা উৎপাদন করে তিনি যথেষ্ট লাভবান হতে পারবেন বলে আশাবাদী।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নূর-এ-নবী জানান, প্রতিবছর ভোজ্যতেল আমদানির পেছনে যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় তা কমিয়ে আনতে কৃষকদের সরিষার আবাদ বৃদ্ধির জন্য প্রতিনিয়ত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।

উন্নতজাতের সরিষা চাষে কৃষকদের মাঝে মাঝে প্রণোদনার মাধ্যমে উপকরণ সহায়তাসহ নানা পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

তাছাড়া তেল জাতীয় প্রকল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের প্রদর্শনী দেয়া হচ্ছে ফলে কৃষকরা সরিষা চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন আমরা মোট ৩ হাজার ৫’শত জন কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে সরিষার বীজ ও সার প্রদান করেছি।
এবিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ষষ্টী চন্দ্র রায় জানান, এ জমিতে শুধু সরিষায় নয় কিভাবে বোরো ও আমন ধান চাষের জন্য কি জাত ব্যবহার করা যায় পাশাপাশি অন্যান্য ফসলও চাষাবাদ করা যায় সে বিষয়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে আসছে।

তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে সরিষার আবাদ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং অচিরেই ভোজ্য তেল আমদানি করা বাদেই সরিষা থেকে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। জেলায় এবছর সরিষার লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৬০৬ হেক্টর জমিতে কিন্তু আবাদ হয়েছে ১২ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *