মো. সাজ্জাতুল ইসলাম, গৌরীপুর ( ময়মনসিংহ) :
কালের আবর্তে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বছরব্যাপী নানা ঘটনায় অতিক্রম করেছে বিদায়ী বছর-২০২৪। এ সালেই গৌরীপুরে ঘটে গেছে বহু আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা।
ঘটনাবহুল এই বছরটিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় জুলাই-আগস্ট আন্দোলন। যা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে । আন্দোলন- সংঘর্ষ- রাজনৈতিক পালা বদলে উত্তাল ছিল রাজপথ। ২০২৪ সালে জুলাইয়ে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের কোটা সংস্কারের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সরকারের দমন-নিপীড়নের মুখে তা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়।
এক মাসের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের অপশাসনের। বছরের শুরুতে বিতর্কিত ডামি নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতার আসনে বসার মাত্র ৮ মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে দেশ ত্যাগ করে পালাতে হয় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের।
এসময় পতিত সরকারের প্রভাবশালী এমপি ও দলীয় নেতাকর্মীদের একসঙ্গে ‘পলায়ন’ এর বিষয়টিও ছিল নজিরবিহীন।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে উত্তাল ও স্লোগানে মুখর ছিল গৌরীপুরের রাজপথ।
আন্দোলনের শুরু থেকেই গৌরীপুরের রাজপথে সরব ছিলেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ২০ আগস্ট কারফিউ ভেঙ্গে ময়মনসিংহ কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এদিন দফায় দফায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এসময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের গুলিতে তিনজন নিহত ও অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত এবং অনেকের অঙ্গহানির ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারী নিহত তিনজন হলেন বিপ্লব হাসান, জোবায়ের আহমেদ ও নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব।
স্থানীয় প্রশাসনের চাপের মুখে ময়না তদন্ত ছাড়াই ওইদিন রাতেই তড়িঘড়ি করে তাদের দাফন করতে হয়েছে। তখন পুলিশের ভয়ে নিহত তিনজন শহিদের পরিবারে খোজ খবর নিতে পারেননি কেউই। নিজ সন্তানদের হারিয়েও উৎকন্ঠায় কেটেছে শহিদ পরিবারগুলো। ফ্যাসিবাদের এই হুমকি উপেক্ষা করে অবশেষে তিন শহিদ পরিবারের খবরাখবর নিতে তাদের বাড়িতে যান দৈনিক নয়া দিগন্তের ময়মনসিংহের ব্যুরো প্রধান মো: সাইফুল মাহমুদ ও গৌরীপুর প্রতিনিধি মো. সাজ্জাতুল ইসলাম।
তাদের দেখে কেউ কাছে আসতে চান না। প্রতিবেশীরা দুর থেকে উকি মারছেন কিন্তু কেউ মুখ খুলছেন না। তারপরও পরিবারের সহযোগীতায় তিন শহিদের করুণ মৃত্যুর ঘটনা ও পারিবারিক দুরাবস্থার কথা ধারাবাহিক ভাবে স্থান করে নেয় দৈনিক নয়া দিগন্তের শেষ পাতায়। এরপর সারাদেশ থেকেই এই পরিবারগুলো খোজখবর নেওয়া শুরু হয়।
আন্দোলনে তিনজনের মৃত্যু কাঁদিয়েছে গৌরীপুরবাসীকে :
শহিদ বিপ্লব হাসান: গৌরীপুর উপজেলা কলতাপাড়া গ্রামের মো. বাবুল মিয়ার ছেলে বিপ্লব হাসান। বিপ্লব হাসান স্থানীয় মোজাফফর আলী ফকির উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০২৩ ও ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেও দুবারই অকৃতকার্য হন। রিকশার মিস্ত্রি বাবার একার আয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয় দেখে স্থানীয় কৃষাণী তেলের ফ্যাক্টরীতে চাকরি নেন তিনি। ২০ জুলাই সকালে হঠাৎ তিনি বন্ধুদের ফোন কল পেয়ে বাইরে যান।
তখন বাজারে নাশতা করবেন বলে মায়ের কাছে টাকা চেয়ে নিয়েছিলেন বিপ্লব। রাতে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেন বিপ্লব। রাতে বাড়ির সামনেই বিপ্লবকে দাফন করা হয়। বিপ্লবের বাবা বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করত না। পুলিশের গুলিতে আমার ছেলে মারা গেল, সরকারের কাছে এই বিচার চাই।’
শহিদ জোবায়ের আহমেদ : উপজেলা পুর্ব কাউরাট গ্রামের আনোয়ার উদ্দিনের ছেলে জোবায়ের আহমেদ। তিনি শম্ভুগঞ্জ বাজারের ব্যবসা করতেন। ২০ জুলাই সকালে দোকান খুলতে যাচ্ছিলেন তিনি। কলতাপাড়া এলাকায় তিনি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন।
জোবায়েরের বাবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আনোয়ার উদ্দিন বলেন, ২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় এক বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার পর জোবায়ের ব্যবসা শুরু করেন। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে তাঁর মোবাইলের দোকান আছে। এক বছর আগে ছেলে বিয়ে করেছিলেন। রাতে ছেলের লাশ বাড়িতে আনার পর দেখিছি শরীরের বুকের বাঁ পাশে বুলেটের আঘাত। পরে রাতেই বাড়ির পাশে তাকে দাফন করা হয়।
শহিদ নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব :
গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও মধ্যপাড়া গ্রামের আবদুল হালিমের ছেলে নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব। তিনি হেফজ বিভাগ শেষ করে ঈশ্বরগঞ্জের ভাসা মাদ্রাসায় পড়ছিলেন। একই সঙ্গে নিজেদের বাড়িতে তা’লিমুল কোরআন মহিলা মাদ্রাসা নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে শিক্ষকতা করছিলেন।
২০ জুলাই সকালে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পেটে ব্যথা হওয়ায় ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিব। ছাত্রজনতা সংঘাতে নিহত তিনজনের একজন তিনি। তাকেও ময়না তদন্ত ছাড়া রাতেই দাফন করতে হয়।
স্থানীয়রা জানান, নূরে আলমের নিজের একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে। ইসলামি ভিডিও বানিয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে দিতেন তিনি। মানুষের কাছে শুনেছেন, ভিডিও করার সময় তাঁকে গুলি করা হয়। নূরে আলমের মোবাইল ফোনটিও পাওয়া যায়নি।’ সংঘর্ষের ঘটনা ভিডিও করার সময় পুলিশ তাঁকে গুলি করে।
এ ঘটনার পর থেকে এলাকায় শুরু হয় বিএনপি জামায়াত নেতাকর্মীদের উপর পুলিশি এ্যাকশন। তিনজন শহিদের ঘটনায় গৌরীপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. অনীক ইসলাম বাদী হয়ে ২১ জুলাই বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন। মামলায় বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীদের আসামী করা হয়। মামলার পর গ্রেফতার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য হয়ে পরে কলতপাড়া এলাকা। পুলিশের হয়রানির ভয়ে বাজারের দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছিলো।
অবশেষে ৫ আগষ্টে পটপরিবর্তনের পর গৌরীপুর থানার সকল পুলিশ বাহিনীকে একযোগে বদলী করা হয়। কিন্তু আত্নগোপনে চলে যান তিনজনকে গুলি করে হত্যার মূল নায়ক ওসি সুমন চন্দ্র রায়।
সেই সাথে পালিয়েন যান স্থানীয় এমপি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নিলুফার আঞ্জুম পপি সহ দলীয় নেতাকর্মীরা। উক্ত ঘটনায় সাবেক প্রধান মন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপি, পুলিশের উধ্বর্তন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সহ দ্রুত বিচার আইনে একাধিক হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।