আবু সাইদ শওকত আলী,ঝিনাইদহ:-
১৯টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৫ জন, যা দিয়ে এত বিশাল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া কার্যত অসম্ভব। হাসপাতালটি ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করার জন্য ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন ভবন নির্মাণ করা হলেও ১৭ মাস পেরিয়ে গেলেও সেটি চালুর অনুমোদন মেলেনি।
ফলে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা ভবন থেকে ইতোমধ্যে চুরি হয়েছে টিভি, পানির ট্যাপসহ মূল্যবান সরঞ্জাম।
অপ্রতুল জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের কারণে প্রতিদিন হাজারো রোগী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অনেকেই শেষ পর্যন্ত সেবা না পেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট চরমে
কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১২০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। আউটডোরে সেবা নিতে আসেন ৮০০ থেকে ১০০০ রোগী, যা গরমের সময় বেড়ে দাঁড়ায় ১২০০ থেকে ১৫০০ জনে।
এত বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবা দিতে প্রয়োজনীয় জনবল নেই বললেই চলে। হাসপাতালের ১৯টি চিকিৎসক পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৭ জন, তবে এদের মধ্যেও ২ জন রয়েছেন ডেপুটেশনে। ফলে কার্যত চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ৫ জন। আগামী ২৫ তারিখে আরও ২ জন কনসালটেন্ট বদলির আদেশ পাওয়ায় পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হতে চলেছে।
শূন্যপদের দীর্ঘ তালিকা
এই হাসপাতালে ৫০ শয্যার জন্য মোট ১২৪টি পদের অনুমোদন থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৭১ জন। শূন্য রয়েছে ৫৩টি পদ।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু শূন্যপদের চিত্র:
- চিকিৎসক: ১৯ পদের মধ্যে কর্মরত ৭ জন, শূন্য ১২টি
- নার্স: ৩২ পদের মধ্যে কর্মরত ২৮ জন
- মেডিকেল টেকনোলজিস্ট: ৮ পদের মধ্যে কর্মরত ৫ জন
- ফিল্ড স্টাফ: ১৮ পদের মধ্যে কর্মরত ৮ জন, শূন্য ১০টি
- ফার্মাসিস্ট, স্যাকমো, স্বাস্থ্য পরিদর্শক, কার্ডিওগ্রাফারসহ অন্যান্য পদ: মোট ৪৫টির মধ্যে শূন্য ২৪টি
এত সংখ্যক পদ শূন্য থাকায় চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। রোগীদের চিকিৎসা পেতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এমনকি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় টেস্ট করানোর জন্যও পর্যাপ্ত টেকনোলজিস্ট না থাকায় রোগীদের বাধ্য হয়ে বাইরের বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হচ্ছে।
সেবার মান নিম্নমুখী, রোগীদের দুর্ভোগ চরমে
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের দীর্ঘ লাইন ও অপেক্ষার সময় এখন নিত্যদিনের ঘটনা। রবিবার সকাল ১১টায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসকের কক্ষের সামনে অন্তত ২০০ রোগী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
পারলাট গ্রামের হামিদা বেগম বলেন, “প্রেসার ও গ্যাসের সমস্যার কারণে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। কিন্তু এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও ডাক্তার দেখাতে পারিনি। টাকা দিয়ে বাইরের ক্লিনিকে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, হাসপাতালেই চিকিৎসা পেতে চাই।”
আযমপুরের সামাউল বলেন, “আঘাতজনিত ব্যথা নিয়ে এসেছি, কিন্তু যে ভিড় দেখছি, আদৌ ডাক্তার দেখাতে পারবো কিনা সন্দেহ।”
এমন অবস্থায় অনেকে চিকিৎসা না পেয়েই ফিরে যেতে বাধ্য হন। আবার অনেককে উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোর জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়।
১০০ শয্যার ভবন চালুর অনুমোদন নেই, চুরিও হচ্ছে সরঞ্জাম
জনগণের উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে ৫০ শয্যার হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় এবং ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়। কিন্তু দীর্ঘ ১৭ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো প্রশাসনিক অনুমোদন না পাওয়ায় ভবনটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও জনবল বরাদ্দ করা হয়নি, যার কারণে সেবার মানের কোনো উন্নতি হয়নি।
এদিকে দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকার কারণে ভবনের মূল্যবান সরঞ্জাম চুরি হয়ে গেছে। চোরেরা টিভি, পানির ট্যাপসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে গেছে, যা দেখভালের অভাবে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া
কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আমান উল্লাহ মামুন বলেন, “আমি কয়েক মাস আগে এখানে যোগদান করেছি। হাসপাতালটি ৫০ শয্যার হলেও প্রচুর জনবল সংকট রয়েছে। চিকিৎসক, নার্স, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অনেক পদ শূন্য রয়েছে। সীমিত জনবল দিয়ে যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে শূন্য পদগুলো পূরণ করা না হলে জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “১০০ শয্যার জন্য নতুন ভবন নির্মাণ করা হলেও এখনো প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তাই সেখানে জনবল ও বাজেট বরাদ্দ হয়নি। দ্রুত অনুমোদন পেলে হাসপাতালের সেবা অনেকাংশে উন্নত করা সম্ভব হবে।”
কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন
কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শুধু উপজেলাবাসীর নয়, আশেপাশের ৫টি উপজেলার রোগীদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা কেন্দ্র। কিন্তু চিকিৎসক সংকট ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে এটি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি দ্রুত শূন্যপদগুলো পূরণ এবং ১০০ শয্যার ভবন চালুর অনুমোদন দেয়, তাহলে অন্তত দুই লাখ মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। অন্যথায়, সাধারণ রোগীদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে, এবং স্বাস্থ্যসেবার মান আরও নিচের দিকে নামবে।
সমাধানের দাবিতে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয়দের দাবি, দ্রুত জনবল সংকট দূর করে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রমকে আরও উন্নত করতে হবে। ১০০ শয্যার হাসপাতাল ভবন চালুর জন্য দ্রুত প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হলে কোটচাঁদপুরের জনগণ সরকারি হাসপাতাল থেকে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পেতে পারবে।
এখন দেখার বিষয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কবে নাগাদ এসব সমস্যার সমাধান করবে, এবং কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে জনগণের জন্য একটি কার্যকরী হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তুলবে।