আবু সাইদ শওকত আলী,বিশেষ প্রতিনিধি :-
বিদেশে স্বচ্ছল জীবনের স্বপ্নে প্রলুব্ধ হয়ে সবকিছু বিকিয়ে দিয়েছেন তারা—কারো বন্ধক রাখা জমি,
কারো বিক্রি হওয়া শেষ গরু, কেউ আবার এনজিওর কাছ থেকে নিয়েছেন চড়া সুদে ঋণ।
কিন্তু স্বপ্ন নয়, বাস্তবে তারা পেয়েছেন ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন। এমনই করুণ পরিণতির শিকার হয়েছেন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর উপজেলার অন্তত ১২টি পরিবার।
স্থানীয় সূত্র ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোটচাঁদপুর উপজেলার কাগমারী গ্রামের আদম ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম ও তার
কাতার প্রবাসী ছেলে মাসুম বিল্লাহ মামুন মিলে দীর্ঘদিন ধরে কাতারে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে প্রবাসে যুবকদের পাঠিয়ে আসছেন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে নজরুল-মামুন চক্রটি ৪ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে।
অথচ কাতারে পৌঁছানোর পর তারা কোনো বৈধ চাকরি তো দূরের কথা, ঠিকমতো থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থাও পায়নি।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ১২ জন যুবককে কাতারের উম সালাল মোহাম্মদ এলাকায় পাঠানো হয়। সেখানে একটি ছোট বাসায় গাদাগাদি করে
রাখা হয়েছে তাদের। বৈধ ওয়ার্ক পারমিট বা কাজের কোনো ব্যবস্থা নেই।
দিনের পর দিন তারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করছে। শুধু তাই নয়, প্রতারক চক্রটির পক্ষ থেকে
হুমকি দেওয়া হচ্ছে, অতিরিক্ত টাকা না পাঠালে দেশে ফিরবে লাশ!
নিঃস্ব পরিবার, নিঃশেষ স্বপ্ন:-কাগমারী গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ হানিফ বলেন,ছেলেকে বিদেশ
পাঠিয়ে সংসারটা একটু ভালোভাবে চলবে ভেবেছিলাম।
সব বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা দিয়েছি নজরুলকে। এখন ৮ মাস হলো কোনো কাজ নেই, ছেলেটা
কাতারে না খেয়ে আছে। আমাদের আবার বলছে টাকা পাঠাতে!”
একই গ্রামের বিধবা নারী নুরজাহান বেগমের কণ্ঠে ক্ষোভ আর হতাশাজমি বন্ধক রেখে,গরু বিক্রি
করে, এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে টাকা দিয়েছি। এখন দালাল বলছে, আরও দুই লাখ টাকা না
দিলে কিছু হবে না। খাই কীভাবে? আবার টাকা দেবো কোথা থেকে?”
তবিবুর রহমান নামের এক ভুক্তভোগী বলেন,ছেলের ভবিষ্যতের জন্য আমরা সব
হারালাম। এখন আবার টাকা না পাঠালে বলছে খোঁজও পাওয়া যাবে না। এই প্রতারকরা যেন আর কাউকে সর্বনাশ করতে না পারে, আমরা আইনের আশ্রয় চেয়েছি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ:-এই ঘটনায় ইতোমধ্যে একটি পরিবার কোটচাঁদপুর থানায়
লিখিত অভিযোগ দিয়েছে এবং আরেকটি পরিবার আদালতে প্রতারণা ও মানবপাচারের অভিযোগে মামলা করেছে।
অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে নজরুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যরা পলাতক রয়েছেন।
তাদের গ্রামের বাড়িতে তালা ঝুলছে, বন্ধ রয়েছে মোবাইল ফোন।
এ বিষয়ে কোটচাঁদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কবির হোসেন মাতুব্বর বলেন,ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে স্থানীয়ভাবে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়েছিল।
কিন্তু অভিযুক্তরা পলাতক থাকায় তা সম্ভব হয়নি। ভুক্তভোগীদের আদালতের শরণাপন্ন হতে বলা হয়েছে।”
মানবপাচার নাকি প্রতারণা চক্র?
স্থানীয়দের দাবি, নজরুল-মামুন চক্র দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের প্রতারণা চালিয়ে আসছে।
একাধিকবার বিদেশে লোক পাঠানোর নামে টাকা হাতিয়ে নিলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এতে করে প্রতারণার মাত্রা বাড়ছে, সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন
ভুক্তভোগীরা দ্রুত নজরুল-মামুন চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, আটকে পড়া যুবকদের দেশে ফিরিয়ে আনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
এই ঘটনায় মানবপাচার দমন আইন, ২০১২ অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে আরও অনেক পরিবার এমন প্রতারণার শিকার হতে পারে
বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় মানবাধিকারকর্মীরা। প্রশাসনের জরুরি পদক্ষেপ ছাড়া পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।