আবু সাইদ শওকত আলী,বিশেষ প্রতিনিধি:-
“স্বপ্ন সেটি নয় যা ঘুমিয়ে দেখি, স্বপ্ন সেটি যা আমাকে ঘুমাতে দেয় না”—এই কথাটিই যেন বাস্তবে রূপ
দিয়েছেন নেত্রকোণার প্রত্যন্ত গ্রামের মেধাবী তরুণ শাকিল আল-আমিন।
সামান্য ফলাফল আর সীমাহীন দারিদ্র্যের বাধা পেরিয়ে কীভাবে একজন মানুষ দেশের সর্বোচ্চ
প্রতিযোগিতামূলক চাকরি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)-এ জায়গা করে নিতে পারেন—তার বাস্তব প্রমাণ শাকিল।
এসএসসিতে মাত্র জিপিএ ৩.৩৮ পেলেও হাল ছাড়েননি। আত্মবিশ্বাস, কঠোর পরিশ্রম ও অদম্য মানসিকতায় পাড়ি দিয়েছেন বিসিএস নামক লম্বা
পথ। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত, কর্মস্থল ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী আনন্দ মোহন কলেজ।
■ শুরুটা সহজ ছিল না
২০০৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় মাত্র জিপিএ ৩.৩৮ পান শাকিল। এই ফলাফল অনেকের চোখে তেমন
কিছু না হলেও, তার গ্রামের মধ্যে সেটাই ছিল
সর্বোচ্চ। তবে স্বপ্ন ছিল অনেক বড়, আর সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে এগিয়ে যান উচ্চশিক্ষার পথে।
পরিবারের অভাব, আর্থিক অনটন, এক সময় আত্মীয়ের এনজিওতে চাকরি করার সুযোগ
এসেছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ না করে পা বাড়ান সংগ্রামের পথে। ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে ভর্তি হন নেত্রকোণা সরকারি কলেজে।
■ হারিকেনের আলোয় রাত জাগা স্বপ্ন
কলেজে ভর্তি হলেও থাকার জায়গা ছিল না। বাধ্য হয়ে লজিং বাড়িতে উঠেন এবং বিনিময়ে পড়াতে
শুরু করেন ছোট ছেলেমেয়েদের। আর্থিক সংকটের কারণে বিদ্যুতের আলো পাননি, হারিকেনের ক্ষীণ
আলোয় রাত জেগে চলেছে তার প্রস্তুতি।
তার ভাষায়,
“আমার বন্ধুদের অর্ধেকই A কিংবা A+ পেয়েছিল। আমি কখনোই দমে যাইনি। জানতাম—তিনবেলা
ভাত, মাথা গোঁজার জায়গা, আর হারিকেনের কেরোসিন পেলেই আমি এগোতে পারব।”
এই সময় তার বাবা একটি ছোট গরু বিক্রি করে পাঠান ময়মনসিংহে, ভর্তি কোচিংয়ের জন্য। বাবার এই আত্মত্যাগ আর নিজের অদম্য সংকল্প তাকে আরও দৃঢ় করে।
■ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন পূরণ
এইচএসসি পরীক্ষায় শাকিল অর্জন করেন জিপিএ
৪.১০। সেই ফলাফলে সুযোগ পান দেশের শীর্ষস্থানীয় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, তাই ভর্তি হন
সরকার ও রাজনীতি বিভাগে।
দীর্ঘ চার বছর তিনি কঠোর পরিশ্রম করে সফলভাবে সম্পন্ন করেন অনার্স ও মাস্টার্স।
নিজের খরচ নিজেই চালিয়েছেন টিউশন করে। ঘরে ঘরে গিয়ে ছাত্র পড়ানো, আর ক্যাম্পাসে ক্লাস করা ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন।
■ বিসিএস জয় করার গল্প
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করেন শাকিল। পড়াশোনায় কখনোই ফাঁকি
দেননি। প্রতিদিন ১২–১৪ ঘণ্টা পড়াশোনা করেছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস নিরবচ্ছিন্ন
অধ্যবসায়ের ফলস্বরূপ তিনি উত্তীর্ণ হন ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায়। পেয়েছেন শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ।
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা এবং কর্মরত ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে প্রভাষক হিসেবে।
■ শিক্ষার্থীদের প্রতি বার্তা
‘দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শাকিল আল-আমিন বলেন,“আমি কখনো হতাশ
হইনি। আমার স্বপ্ন আমাকে ঘুমাতে দিত না। আমি জানতাম, একদিন আমি পারব।”
তিনি আরও বলেন,
“পরিশ্রম কখনো কাউকে বিনা পারিশ্রমিকে বিদায় করে না। আমার বাবা গরু বিক্রি করে কোচিংয়ে
পাঠিয়েছিলেন, সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ তার স্বপ্ন ও চেষ্টার সমান বড় হয়।”
তরুণদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ দিয়ে বলেন,“ফলাফল জীবনের চূড়ান্ত মূল্যায়ন নয়। তুমি যদি পরিশ্রম
করতে পারো, নিজেকে বিশ্বাস করতে পারো—তবে যেকোনো স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হবে। হতাশ না হয়ে
সামনে এগিয়ে যাও। নিজেকে খুঁজে বের করো, তোমার শক্তিকে কাজে লাগাও।”
■ সারসংক্ষেপ:
তথ্য
বিবরণ
নাম
শাকিল আল-আমিন
এসএসসি
৩.৩৮ (২০০৬ সাল)
এইচএসসি
৪.১০
বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (সরকার ও রাজনীতি বিভাগ)
বিসিএস
৩৬তম, শিক্ষা ক্যাডার
বর্তমান কর্মস্থল
আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ
পিতা
গরু বিক্রি করে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন কোচিংয়ে
সংগ্রাম
টিউশন, লজিং, হারিকেনের আলো, ১২-১৪ ঘণ্টা অধ্যয়ন
■ উপসংহার
শাকিল আল-আমিনের জীবনগল্প আমাদের শিখিয়ে দেয়—ফলাফল নয়, ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায়ই
মানুষকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেয়। তিনি শুধু একজন বিসিএস ক্যাডার নন, বরং তিনি হাজারো তরুণের অনুপ্রেরণার নাম।
তার এই জীবনসংগ্রাম প্রমাণ করে—স্বপ্ন বড় হলে, অভাব কোনো বাধা হতে পারে না।
নিজেকে বিশ্বাস করো, ঘুরে দাঁড়াও—তোমার পথও তৈরি হবে।