বিশেষ প্রতিবেদক:-
বাংলাদেশের নাট্য ও চলচ্চিত্রাঙ্গনের অন্যতম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত। তবে অনেকেই জানেন না, এই বর্ষীয়ান অভিনেতা একজন প্রকৌশলীও বটে।
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পেশাগত জীবন শুরু করলেও
পরবর্তীতে মঞ্চ, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রে নিজের মেধা ও প্রতিভার অসাধারণ প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
নন্দিত এই অভিনেতার জন্ম ১৯৪৩ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদে। তাঁর পিতার কর্মসূত্রে তিনি বেড়ে ওঠেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের
চট্টগ্রামে। শিক্ষাজীবনের শুরু চট্টগ্রাম কলেজিয়েট ও রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে, যেখানে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। পরে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে
আইএসসি পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় পাড়ি জমান। ভর্তি হন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান বুয়েট)-এ এবং ১৯৬৭ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবনের শুরু ও অভিনয়ে পদার্পণ
স্নাতক সম্পন্ন করার পর ১৯৬৮ সালে ঢাকা ওয়াসায় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আবুল
হায়াত। তবে প্রকৌশলী হিসেবে দীর্ঘদিন না থেকেও তিনি নিজের জীবনের প্রকৃত খ্যাতি ও পরিচিতি গড়ে তোলেন অভিনয়ের মাধ্যমে। ১৯৬৯ সালে বিটিভিতে
প্রচারিত গ্রিক ট্র্যাজেডি ‘ইডিপাস’ নাটকের মাধ্যমে তার অভিনয় জীবনের সূচনা ঘটে। এরপর থেকে দীর্ঘ
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিয়মিত অভিনয়ে যুক্ত রয়েছেন।
অভিনয়জীবন ও অবদান
আবুল হায়াত এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন। বাংলা নাটকের ইতিহাসে তার
অবদান অনস্বীকার্য। ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘তৃতীয় পক্ষ’ ইত্যাদি জনপ্রিয়
নাটকগুলোতে তার অভিনয় দর্শকমনে আজও গেঁথে আছে।
নাটক ছাড়াও চলচ্চিত্রে তার উপস্থিতি স্মরণীয়। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে,
‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’,
‘আগুনের পরশমণি’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘জয়যাত্রা’, ‘গহীনে শব্দ’, ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ প্রভৃতি।
বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি চরিত্রে তার অভিনয় ছিলো অত্যন্ত প্রশংসিত।
নির্মাতা ও লেখক হিসেবে
অভিনয়ের পাশাপাশি নির্মাতা হিসেবেও সফল ছিলেন তিনি। তাঁর পরিচালিত জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘জোছনার ফুল’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ইত্যাদি।
একই সঙ্গে একজন সাহিত্যিক হিসেবেও আবুল হায়াত পরিচিত। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস ‘আপ্লুত মরু’ পাঠকমহলে প্রশংসিত হয়। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়,‘নির্ঝর সন্নিকট’,
‘এসো নীপবনে’, ‘অচেনা তারা’, ‘জীবন খাতার ফুটনোট’, ‘জিম্মি’ ইত্যাদি বই, যেগুলোতে জীবনের
অভিজ্ঞতা, আবেগ ও দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবন
ব্যক্তিগত জীবনে আবুল হায়াত বিবাহ করেন মাহফুজা খাতুন শিরিনকে, যিনি তার মেজ বোনের ননদ। তাদের দুই কন্যা,বিপাশা হায়াত, দেশের খ্যাতিমান অভিনেত্রী ও চিত্রশিল্পী;
এবং নাতাশা হায়াত, যিনি নিজেও সংস্কৃতিচর্চায় যুক্ত।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
তাঁর দীর্ঘ অভিনয়জীবন ও সাংস্কৃতিক অবদান সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে খুব বেশি পুরস্কার না পেলেও তিনি
দর্শকমনে আজও চিরস্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন। ২০০৭ সালে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ সিনেমায় পার্শ্বচরিত্রে
অনবদ্য অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন।
উপসংহার
একাধারে প্রকৌশলী, অভিনেতা, নির্মাতা ও লেখক আবুল হায়াত এক বহুমাত্রিক প্রতিভার প্রতীক।
শিক্ষাজীবনের সূচনা যেখানে প্রকৌশলের পথে, সেখান থেকে অভিনয় ও সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি
দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক বিশিষ্ট জায়গা করে নিয়েছেন। আগামী প্রজন্মের জন্য তিনি এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।